তসলিমা নাসরিন-এর ‘সিঁদুর’



ভাগ্য বদলাতে কৃষ্ণনগর থেকে দিল্লি চলে এসেছিল সলিল দাস। চাষের জমি যেভাবে ছিল সেভাবেই ফেলে। ও জমি যে ফসল দিচ্ছিল, তাতে খেয়ে পরে বাঁচা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ভাইকে ঠিক লিখে পড়ে দিয়ে আসেনি, বলে এসেছে, ‘জমিটা দেখিস, নিজে চাষবাস করিস’। ভাই হাজার পাঁচেক টাকা হাতে দিয়েছিল। সেই যে সলিল দাস এসেছে দিল্লিতে, আর ফিরে যায়নি গ্রামে। উঠেছে গোবিন্দপুরির বস্তিতে। বস্তিতেই গ্রামের দুটো চেনা লোক ছিল, ওরাই গোবিন্দপুরিতে তাকে ঘর পেতে, কাছেপিঠে কাজ পেতে সাহায্য করেছে।

সলিল দাস করে গার্ডের চাকরি, প্রমিলা আর তার মা আরতি করে লোকের বাড়িতে রান্নার আর সাফসাফাইয়ের কাজ। এতে থাকা-খাওয়া দিব্যি চলে যায় তিন সদস্যের, কিছু টাকাও জমানো হয় প্রমিলার বিয়ের জন্য। বিয়ে তুঘলকাবাদের এক বাঙালির ঘরেই দেওয়া হয়, তারাও কৃষ্ণনগরের। বাবা মা দেখে শুনে বিয়ে দিয়েছে। কী দেখেছে, কী শুনেছে, প্রমিলা জানে না। শ্বশুর বাড়িতে ওঠার পরদিন থেকেই সে দেখছে বাড়ির বারো জনের সমস্ত কাজ তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে, পান থেকে চুন খসলেই গালির ধুম শুরু হয়। বর কখনও মাতাল হয়ে মাঝ রাত্তিরে ফেরে, কখনও ফেরেই না। প্রমিলা তার পনেরো বছর বয়সে এই জীবনকে মুখ বুজে মেনে নেয়। এছাড়া কোনও উপায় নেই তার। বাবা মা’কে সব জানিয়েও তার নিরন্তর যন্ত্রণা থেকে, দাসিবাঁদির জীবন থেকে, একদিনের জন্যও সে মুক্তি পায়নি।

প্রমিলাকে গ্রামের ইস্কুলে চার ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়েছে সলিল দাস। কিন্তু পুত্র প্রণয়কে পড়িয়েছে মাধ্যমিক পর্যন্ত। মাধ্যমিক পাশ করে প্রণয় চলে গেছে কেরালার কারখানায় কাজ করতে। কেরালায় কৃষ্ণনগরের চেনা যারা কাজ করে, তাদের কাছেই প্রণয়ের খবর জানতে পারে সলিল দাস। প্রণয় ভালো আছে, ভালো রোজগার করছে। প্রমিলার বিয়ের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে বলেছিল। চিঠির জবাব দেয়নি প্রণয়। নিজে আসেওনি বিয়েতে। পুত্র পুত্র করে অজ্ঞান ছিল সলিল দাস আর আরতি। সেই পুত্র বাপমা’র অসুখে বিসুখে আপদে-বিপদে একবার দেখতেও আসে না। সলিল দাস একদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘ছেলে তো মনে হয় বাপ মা মরলে মুখাগ্নি করতেও আসবে না’। আরতি দীর্ঘশ্বাস ফেলেনি, বলেছিল, ‘না আসুক, আমাদের প্রমিলাই করবে মুখাগ্নি’।

প্রমিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আরতি অনেকটা একা হয়ে যায়। আগে এক সংগে কাজে বেরোতো, একই ব্লকে মা মেয়ে কাজ করতো। মা কাজ শেষ হয়ে গেলে পার্কে অপেক্ষা করতো, মেয়ে কাজের পর পার্ক থেকে মা’কে তুলে মেশিন বসানো ইরিক্সায় বাড়ি ফিরতো। সেই দিন আর নেই। প্রমিলার শ্বশুর বাড়িতে কী হচ্ছে তার খবর পায় আরতি। অপেক্ষা করে একদিন দুর্দিন কেটে যাবে। কিন্তু দুর্দিন কাটে না। একদিন প্রমিলাকে শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ দেবর আর স্বামী মিলে প্রচুর মারলো। কী, নিতাই দু’হাজার টাকা বালিশের তলায় রেখেছিল, সেটি এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রমিলাকে তার মা দেখতে এসেছিল দু’দিন আগে, নিশ্চয়ই টাকাটা মায়ের হাতেই পাচার করেছে। শাশুড়ি বললো, আলমারিতে তার সোনার দুল ছিল, নেই। ননদও এসে বললো, তার রূপোর হারটাও সে পাচ্ছে না। মার খেয়ে গা কেঁপে জ্বর এসেছিল প্রমিলার, বিছানায় পড়ে ছিল তিন দিন। কেউ খেতে দেয়নি কিছু। খবর পেয়ে আরতি এসে প্রমিলাকে বাড়ি নিয়ে যায়। শাশুড়ি বলে দেয়, আর যেন এ ডাইনি ফিরে না আসে।

বাপমা’য়ের কাছে দু’মাস সে বসে রইলো। নিতাই আসেনি তাকে নিতে। আশা ছেড়ে দিয়ে কাজে ঢুকলো প্রমিলা। খুব সকালে উঠে ভালো জামাজুতো পরে, লম্বা চুল মাথার পেছনে টেনে নিয়ে খোঁপা করে, মোটা করে সিঁথিতে সিঁদুর পরে, ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হনহন করে হেঁটে যায় ইরিক্সা ধরতে। এভাবে এক বর্ষা গিয়ে আরেক বর্ষা আসে, নিতাই যোগাযোগ করেনা। সলিল দাস দু’বছরে ছ’দিন গেছে প্রমিলার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করতে প্রমিলাকে কেন তারা নিয়ে আসছে না! ছ’বারই শ্বশুর বলেছে নিতাই চাইলেই তারা নিয়ে আসবে। নিতাই চাইছে না। নিতাইয়ের মা’ও চাইছে না। সলিল দাস লোকের নিন্দের ভয়ে প্রমিলাকে তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে চায়। ভয় না থাকলে মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছেই রাখতো। মেয়েকে কাছে পেয়ে সলিল দাস সুখী। পুত্র তো থেকেও নেই। সন্তান বলতে এখন এই দুঃখী মেয়েটাই। বাপের কাছে হাত না পেতে নিজের খরচ নিজে চালানোর জন্য লোকের বাড়িতে কাজ করছে। প্রতি মাসেই নিজের খরচটুকু রেখে মাইনের বাকি টাকা বাপ-মায়ের হাতে তুলে দিচ্ছে।

শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আসার কয়েক মাস পর প্রমিলা একটি সন্তান জন্ম দেয়। বাড়িতেই ধাত্রী আসে, প্রিয়াঙ্কা জন্মায়। এ সময় শ্বশুর বাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে নিতাইকে, খবর দেওয়া হয়। কেউ আসেনি দেখতে। প্রমিলা নিতাইয়ের হোয়াটসআপে পাঠিয়ে দেয় প্রিয়াঙ্কার ছবি। ওদিক থেকে কোনও উত্তর আসে না। না আসুক, প্রমিলার মনে হয়েছে প্রিয়াঙ্কার যে বাবা, তার অধিকার আছে তার সন্তানের মুখ দেখা। একদিন খবর আসে নিতাই বিয়ে করেছে। এক বউ রেখে ফের বিয়ে? হতেই পারে। কোনও বিয়ে তো রেজিস্ট্রি হয় না। সবই পুরোহিত ডেকে বিয়ে। এই বিয়ের পর আরতি ভেবেছিল প্রমিলা আর সিঁদুর পরবে না। কিন্তু সিঁদুর ঠিকই আগের মতো পরে প্রমিলা।

প্রমিলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে, সে কেন সিঁদুর পরে। কাজের বাড়ির দু’জন মহিলা কোনওরকম সংকোচ বা কোনওরকম সংশয় প্রকাশ না করে তাকে বলেছে, নিতাইকে সে খুব ভালোবাসে, সে কারণেই সিঁদুর পরে। প্রমিলা যে উত্তরটি জানে, সেটি ভিন্ন। মিথ্যে অভিযোগ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যে লোক তাকে পিটিয়েছে, সে লোককে আর যা কিছুই করা যায়, ভালোবাসা যায় না! নিতাই কি তাকে ভালোবাসে? এর উত্তরও প্রমিলা জানে, এর উত্তর নিতাই তাকে ভালোবাসে না। প্রমিলা কি এখনও আশা করে একদিন নিতাই আসবে তাকে নিতে? একসময় আশা করতো, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সে আশা সে জলাঞ্জলি দিয়েছে। তবে সিঁদুর কেন?

সিঁদুর এইজন্য যে সিঁদুর পরলে লোকেরা তাকে রাস্তাঘাটে সমীহ করে। ইরিক্সার লোকে বৌদি বলে ডাকে। হাট বাজারেও সে বৌদি ডাক শোনে। যে সব বাড়িতে সে ঘর মোছে, সে সব বাড়ির মহিলারাও সিঁদুর আর শাঁখা পলা পরে তারই মতো ঘরের বাইরে বেরোয়। প্রমিলাও তাদের মতো সিঁদুর আর শাঁখা পলা পরে। তাদের মতো মাথা উঁচু করে হাঁটে। যখন সিঁদুর ছিল না, কত লোক যে হাত বাড়াতো, বুক খামচে ধরতো, গায়ে ঢলে পড়তো, নিতম্বে চিমটি কাটতো, টাকার লোভ দেখিয়ে শরীর চাইতো।

প্রিয়াঙ্কাকে আরতির কাছে দিয়ে প্রমিলা সাত সকালে বেরিয়ে যায় কাজে। আগে একটি বাড়িতে কাজ করতো। এখন পাঁচটে বাড়িতে করে। সকাল সাতটা থেকে বারোটা পর্যন্ত তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করে, দুটো থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত করে দুটো বাড়িতে ঝাড়ু পোছার কাজ। মাসে বারো হাজার টাকা আয়। প্রমিলা বাপের বাড়ির কাজও করে, এ একেবারেই বিনে পয়সায়। শ্বশুর বাড়ির কাজও বিনে পয়সায় ছিল। তবে বাপের বাড়ির কাজ আর শ্বশুর বাড়ির কাজে বিস্তর তফাত। বাপের বাড়িতে কাজে ফাঁকি দিলেও কেউ তাকে লাথি ঝাঁটা মারে না, কেউ গালি গালাজ করে না, পেটায় না। একটিই ঘর, ঘরে একটিই সিঙ্গেল খাট, সেখানে সলিল দাস ঘুমোন। মাটিতে বিছানা পেতে আরতি, প্রমিলা আর প্রিয়াঙ্কা। এ বাড়িতে হাসি আনন্দে কাটে প্রমিলার। প্রিয়াঙ্কাকে দেখাশোনা করতে হয় বলে সকালের রান্নার কাজ আরতি ছেড়ে দিয়েছে।

প্রিয়াঙ্কার দেড় বছর পার হয়। এমন সময় একদিন রাতে নিতাই আসে। ঘুমে চোখ বুজে আসছে, এমন সময় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কেন নিতাই কেন? নিতাই এসেছে প্রমিলার সঙ্গে জরুরি কথা বলতে। সলিল দাস জিজ্ঞেস করে, কী কথা? আরতি বলে, কী কথা সে আমি কী করে জানবো!
–কে জানবে তাহলে?
–জানবে প্রমিলা।
–কিন্তু এতদিন পর কী কথা তার প্রমিলার সাথে?
–সে প্রমিলাকেই জিজ্ঞেস করো।
প্রমিলা ততক্ষণে বাড়ির বাইরে শিমুল তলায়।

প্রমিলা বলে — কেন এসেছো, কী চাও?
–দেখতে এলাম। শুনলাম বেশ মস্তি করছিস।
–মস্তি কখন করলাম, বাচ্চা বড় করছি।
–ও তো মেয়ে-বাচ্চা। ওকে বড় করে কী লাভ!
–এইসব বাজে কথা বলতে এখানে এসেছো?
–এসেছি তোকে খুব মনে পড়লো তো তাই।
–আমাকে তোমার মনে পড়েছে দু’ বছর পর! আসল কারণ বলো। বাচ্চাকে তুমি নিতে চাইলেও আমি কিন্তু দিচ্ছি না।
–কার না কার বাচ্চা, আমি নিতে চাইবো কোন দুঃখে?
নিতাই জোরে হেসে ওঠে। হাসি থেকে মদের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে প্রমিলার।
এই গন্ধটা সে বেশ চেনে। রাতে রাতে এই গন্ধটা সে পেতো। মদ খেয়ে এসে কী মারটাই না মারতো নিতাই। প্রমিলাকে না মারলে তার মদ হজম হতো না।
–শুনলাম বেশ টাকা কামাচ্ছিস।
–টাকা তো লাগেই। তুমি তো একটা পয়সা দিলে না। বাচ্চা হলো। তোমারই তো বংশ। একে বড় করতে খরচ লাগে না?
–কিছু টাকা দে।
–তোমাকে দেওয়ার টাকা নেই।
–মিথ্যে কথা বলছিস কেন?
–মিথ্যে কথা বলি না।
–টাকা দে, তা না হলে চিল্লাবো।
–চিল্লাও। তাতে কার কী?
নিতাই ঠিকই চিৎকার করে বলতে থাকে যেন ঘিঞ্জি বস্তির সকলে শোনে। –ছিনাল মাগী প্রমিলা কার না কার বাচ্চা পেটে ধরেছে। আমি নিতাই, তার বর, আমি জানিয়ে দিচ্ছি এ আমার বাচ্চা নয়।
প্রমিলা দু’হাতে কান চেপে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঘরের ভেতর বাবা মা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সুখবর শোনার জন্য, তারা ভেবে নিয়েছে নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রমিলাকে ফেরত নিয়ে যেতে এসেছে নিতাই।
–কী রে কী বলেছে রে, প্রিয়াঙ্কাকে তো দেখেনি কোনওদিন, দেখতে চাইলো? ঘরে নিয়ে এলি না কেন?
–সারা পাড়ায় চিৎকার করে জানিয়েছে, প্রিয়াঙ্কা নাকি তার বাচ্চা নয়। টাকা চাইতে এসেছিল, টাকা দিইনি বলে চেঁচালো।
–তোকে নিয়ে যেতে চায়নি?
–আমাকে কোথায় নেবে, ঘরে তো তার বউ আছে।
পরদিন রাতে আবার আসে নিতাই। রাত এগারোটার দিকেই। মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোয়।
এবার আর শিমুল তলায় নয়, ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলে। ঘরে সলিল আর আরতি না ঘুমোলেও চোখ বুজে শুয়ে আছে। প্রিয়াঙ্কা ঘুমিয়ে গেছে। প্রমিলা নিতাইএর কাছে জানতে চাইলো কেন এসেছে সে।
–উত্তর আগের মতোই, বড় টাকা কামাচ্ছিস। কিছু দে।
–আমার কষ্টের কামাই তোমাকে দেব কেন?
–সিঁদুর পরছিস, দিতে হবে না?
–সিঁদুর আমি তোমার জন্য পরছি না।
–তাহলে কোন নাগরের জন্য পরছিস, বল।
–কোনও নাগরের জন্য পরছি না।
–তাহলে কেন পরছিস?
–আমার ইচ্ছে হয় বলে পরছি।
–টাকা না দিলে সবাইকে বলে দেব তুই বেশ্যা।
–কাজ করে খাই, বেশ্যা হতে যাবো কেন?
–তাহলে টাকা দে।
প্রমিলা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশ টাকার একটি নোট এনে নিতাইয়ের হাতে দিয়ে বলে, –এই টাকাটা তোমার বাচ্চার দুধ কেনার টাকা থেকে দিলাম। আর কোনওদিন এখানে টাকা চাইতে আসবে না বলে দিচ্ছি। এলে আমি পুলিশে খবর দেবো।
–দিস তুই, দেখি পুলিশ কাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি বলবো আমার বাড়ি থেকে চুরি করে ভেগেছিস তুই। তারপর জেলের ভাত যে খেতে হবে, সে মনে রাখিস।

সারারাত প্রমিলা ঘুমোতে পারে না। সকালে কাজ করতে গিয়ে ঘুম পায়, ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ে। এভাবে তার চলবে কী করে! তার ভয় হতে থাকে নিতাই কোনও অনিষ্ট করবে তার। প্রমিলা এবং তার পরিবার শ্বশুরবাড়িতে মারধোর করবে না, এই শর্তে প্রমিলাকে ফেরত নেবার কথা বলেছে। নিতাই কোনও শর্তই গ্রাহ্য করেনি । আর বলা নেই কওয়া নেই, এখন এসেছে, তাও দুটো ভালো মন্দ কথা বলতে নয়, অনুশোচনা করতে নয়, ফিরিয়ে নিতে নয়, বাচ্চাকে দেখতে নয়, এসেছে টাকা নিতে। মদের নেশায় মানুষ উন্মাদ হলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জ্ঞান কবেই বা ছিল নিতাইয়ের! প্রমিলা অনুমান করে মদ কেনার টাকা নিতেই সে তার কাছে আসে। কিন্তু একটা লোকের মদের টাকা যোগাড় তাকে করতে হবেই কেন? কী সম্পর্ক এই লোকটার সঙ্গে তার? প্রিয়াঙ্কার বাবা সে, এ ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক তো তাদের মধ্যে নেই। বাচ্চাকে যে দুধ খাওয়ালো না, বাচ্চার খাবার কিনলো না, বাচ্চাকে কোলে নিল না, আদর করল না, ঘুম পাড়ালো না, বাচ্চার চেঁচামেচি শুনলো না, বাচ্চার কাঁথা কাপড় সাফ করল না, বাচ্চা কি আদৌ তার?

এরপরও আরও কয়েকদিন টাকা চাইতে এসেছে নিতাই। একশ’ টাকা নেবে না। তার পাঁচশ’ চাই। পাঁচশ’ই দিয়েছে প্রমিলা। সলিল দাস এরপর বাঁশ রেখেছে দরজার কাছে, এলে পেটাবে বলে। একদিন ঠিকই এলো, প্রমিলা সামনে গেল না, তার বাবাই পিটিয়ে নিতাইকে বিদেয় করেছে।

প্রমিলা যে বাড়িতে সকালে রান্না করে, সে তার পুরোনো বাড়ি। বিয়ের আগেও এ বাড়িতে সে রান্না করতো। বাড়ির মালকিন প্রায়ই প্রমিলার সঙ্গে গল্প করে। প্রমিলাকে যে শ্বশুরবাড়িতে পেটানো হয়েছে, নিতাই যে আবার বিয়ে করেছে, বাচ্চার কোনও খরচ যে সে দেয় না, উল্টে মদ খাওয়ার টাকা নিতে আসে — সবই তাকে বলেছে প্রমিলা।
মালকিন জিজ্ঞেস করে, –তোকে ডিভোর্স দিয়েছে?
–না, দেয়নি।
–হিন্দুদের তো দু’বউ রাখার নিয়ম নেই।
–সে আমি কী জানি! বিয়ে তো করল দুটো!
–তোকে ডিভোর্স না দিলে সেকেন্ড বিয়েটা ইল্লিগ্যাল। বিয়ে রেজেস্ট্রি হয়েছিল তো্?
–তা তো জানি না।
–না হলে তো প্রথম বিয়েটাও ইল্লিগ্যাল।
প্রমিলা হেসে ফেলে।– বিয়ে তো মন্দিরে গিয়ে গলায় মালা পরালেই হয়ে যায়। এ ইল্লিগ্যাল হতে যাবে কেন!
মালকিন আরেকদিন জিজ্ঞেস করল, তুই সিঁদুর পরিস কেন?
প্রমিলা বলেছে, বিয়ে হয়েছে, তাই পরি।
–এ কেমন বিয়ে? স্বামীর সংগে দু’মাস রইলি। তারপর থেকে প্রায় দু’ বছর একা। মেয়েটাকেও একা একাই পুষছিস। সিঁদুর মুছে ফেল।
–মুছে ফেল বললেই তো মুছে ফেলা যায় না। হিন্দু মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়। বিয়ে হলে সিঁদুর শাঁখা পরতেই হয়।
—কে বলেছে একবারই বিয়ে হয়? আমি তো হিন্দু, আমার প্রথম হাজবেণ্ডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আমি তো আবার বিয়ে করেছি।
—আমাদের জাতে ওটা হয় না।
—তোর জাত কী শুনি?
প্রমিলা উত্তর দেয় না। মালকিন প্রশ্ন করে, —তাহলে কি তুই সারাজীবন একাই থাকবি?
এক গাল হেসে প্রমিলা বলে–একা কোথায়? বাবা মা আছে না?
–কিন্তু বাবা মা তো সারাজীবন থাকে না। ওরা না থাকলে?
আবারও হেসে প্রমিলা বলে, –প্রিয়াঙ্কা আছে না?

পুজোয় মালকিন একটা ভালো শাড়ি দেবে প্রমিলাকে। শুনে প্রমিলা খুব খুশি। তবে তার একটি আবদার আছে। –তুমি যে সিঁদুর পরো, সেই সিঁদুর এক কৌটো দিতে হবে আমাকে।

মালকিন লাল শাড়ি, লাল সিঁদুর দুটোই দিল। পুজোতে প্রমিলা সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর পরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরেছে। তার আনন্দ আর ধরে না, এ সিঁদুর কোনও সস্তা সিঁদুর নয়। এই সিঁদুরই তার মালকিন পরে। মন্ডপ দেখার ভিড়ে কত লোক যে তাকে বৌদি বলে ডেকেছে! বৌদি একটু জায়গা দিন, বৌদি ওদিকটায় ভিড় নেই, ওখানটায় যান, এই বৌদিকে বসতে দে, চেয়ার দে। ছোট বড় সবাই তাকে সমীহ করে চলে। এই সমীহটুকুই চায় প্রমিলা। প্রমিলা দেখতে ভালো, রঙ-ও ফর্সা। লোকের বাড়িতে কাজ করা মেয়ে বলে তাকে কেউ মনে করে না। মনে করে দাদা হয়তো আশে পাশেই আছে, বৌদি পেছনে পড়ে গেছে, বা আগে চলে এসেছে। লোকের বাড়িতে কাজ করলে কতই না গালি খেতে হয়, শ্বশুর বাড়িতেও গালি, বাপের বাড়িতেও আজকাল গালি শুরু হয়েছে, যতদিন ওরা ভেবেছিল একদিন নিতাই এসে নিয়ে যাবে মেয়েকে, ততদিন ভালো ব্যবহার করেছে, কিন্তু যখন বুঝে গেল, নিতাই কোনওদিনই আসবে না নিতে, তখন থেকেই প্রমিলাকে বড় বাড়তি লোক বলে মনে করছে, ঘাড়ের ওপর মস্ত বড় বোঝা বলে মনে করছে, প্রিয়াঙ্কাকেও। প্রিয়াঙ্কা জ্বালায়, কাঁদে, প্রিয়াঙ্কাকে দেখতে হয় বলে আরতিকে কাজ কম করতে হচ্ছে। কাজ কম মানেই টাকা কম। অভিযোগের পাহাড় জমছে। তাই কোনও ঘরেই শান্তি নেই প্রমিলার, বরং বাইরেই শান্তি, অচেনা লোকদের মধ্যেই শান্তি। ইরিক্সার ড্রাইভাররা প্রমিলার গায়ের ওপর কাউকে বসতে দেয় না। বৌদির খেয়াল রাখে। এরা কেউ জানেও না প্রমিলার আসলে স্বামী বলতে কেউ নেই। প্রমিলাই একমাত্র জানে তার সিঁদুরের সঙ্গে তার বিয়ের বা নিতাইয়ের কারও কোনও সম্পর্ক নেই।

একদিন মালকিন বললো, –কী রে একা একা থাকিস কী করে? পুরুষ মানুষ তো লাগে। কামনা বাসনা নেই?
প্রমিলা হেসে বলে, –কামনা বাসনা কী জিনিস তা জানিনা, তবে পুরুষ মানুষে কোনও বিশ্বাস নেই দিদি।
— ভালো ছেলে দেখে একটা বিয়ে করে নে।
–কী যে বলো দিদি। হিন্দু মেয়ের বিয়ে একবারই হয়।
–তোদের এই বিয়ে টিয়ের মাথা মুণ্ডু আমি বুঝি না।
–দিদি, তুমি যে বলছো অন্য কোনও ছেলে দেখে বিয়ে করে নিতে। অন্য কোনও ছেলে যে নিতাইয়ের মতো হবে না, তার কোনও গ্যারিন্টি আছে?
একটু থেমে মালকিন বলে,– নিতাই নিতে এলে, বা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নিতে এলে শ্বশুরবাড়িতে ফিরবি?
–না।
–অন্য কোনও পুরুষ যদি তোকে বিয়ে করতে চায়, করবি?
–না।
–কতদিন আর কাজ করে খেতে পারবি?
–না পারলে প্রিয়াঙ্কা খাওয়াবে।
তৃপ্তির হাসি প্রমিলার মুখে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন