সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন তিনি, যে বিষয়েই হাত দিয়েছেন তুলে এনেছেন সোনালি ফসল। প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ রচনাসহ বিপুল তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার (বর্তমান মাদারীপুর) মাইজপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া কীর্তিমান এই লেখকের লেখালেখি শুরু ১৯৫১ সালে। সুদীর্ঘ ৬১ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘বন্দী জেগে আছে’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘জাগরণ হেমবর্ণ’, ‘দাঁড়াও সুন্দর’, ‘মন ভালো নেই’, ‘এসেছি দৈব পিকনিকে’, ‘দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়’, ‘স্বর্গনগরীর চাবি’ ও ‘সোনার মুকুট থেকে’র মতো স্বপ্নময় কাব্যগ্রন্থ এবং ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সেই সময়’, ‘রক্ত’, ‘অর্জুন’, ‘পুরুষ’, ‘অগ্নিপুত্র’, ‘প্রথম আলো’, ‘সরলসত্য’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘রক্ত মাংস’, ‘জীবন যে রকম’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘একা এবং কয়েকজন’ ও ‘মনের মানুষ’র মতো কালজয়ী উপন্যাস। এই অনন্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ও হিন্দু সাহিত্য পুরস্কার। এই পুরস্কার অর্জনের পেছনে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকেই হয়তো মূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি পাঠকের কাছে মূলত কবি হিসেবেই অধিক স্বীকৃত। কবিতাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলার এক অদ্ভুত জাদু ছিল তাঁর কলমে। বিশেষ করে প্রেমের কবিতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি সেখানে এক অনন্য স্রষ্টা। তাঁর প্রেমের কবিতা এতটাই স্পর্শকাতর যে মনে হয় এ তাঁর কথা নয় স্বয়ং কোনো প্রেমিকেরই স্বগতোক্তি। এর অর্থ তাঁর কবিতা হোক প্রেম কিংবা অন্য কিছু নিয়ে রচিত, রচনাকৌশলে তা শুধু মুগ্ধই করে না, ঘটনা আবহের সঙ্গে আমাদের একাত্মও করে ফেলে। এটাই সম্ভবত তাঁর বড় কৃতিত্ব যে তাঁর কবিতা মানুষের হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে যায়। যখন তা হৃদয়ের সামগ্রী হয়ে যায় তখন তা সহজ ও সাবলীল হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আর এই সহজ প্রকাশভঙ্গির জন্যই দুই বাংলার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে তাঁর রয়েছে একটা বিশেষ আসন। তাঁর বহুলপঠিত ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি তাই আজও সব বয়সের মানুষকে এক ধরনের নষ্টালজিকতায় আচ্ছন্ন করে।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
…
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
…
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনা!
এই কবিতায় যে হাহাকার ধ্বনিত তা যেন সব ব্যর্থ প্রেমিকেরই নিজস্ব আর্তনাদ হয়ে যায়। আর এই কাব্যকুশলতাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-কে তাঁর স্বকীয়তায় চিহ্নিত করে যা তাঁকে একটা সময় পর্যন্ত বাংলা কবিতার শাসকে পরিণত করে। এর পেছনে অন্যতম কারণ, তিনি কবিতায় হৃদয়ানুভূতিকে সহজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। প্রেম তাঁর চোখে তাই সর্বব্যাপি হয়ে ওঠে। নইলে ‘নীরার অসুখ’ কবিতায় তিনি কেন বলবেন:
নীরার অসুখ হলে কলকাতায় সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিবে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে?
গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্যÑওরা জানে
নীরা আজ ভালো আছে!
হৃদয়ানুভূতি প্রকাশের এই সহজ ব্যাপ্তিই হচ্ছে সুনীলের কাব্যালঙ্কার, দুরন্ত আকর্ষণ। এই আকর্ষণকে রোমান্টিক ভাবালুতার চাপল্যভরা অভিযোগ তুলে হৃদয় থেকে খারিজ করা কী সম্ভব? যদিও সুনীলের কাব্যবিশ্ব তাঁর তৈরি কাব্য সীমানার মধ্যে আবর্তিত, সেখানে কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের নিত্য সংগ্রামের চালচিত্র নিপুণভাবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। সেইসঙ্গে তাঁর কবিতা থেকে কলকাতার মধ্যবিত্ত পাঠকও নিজেদের সত্তাকে খুঁজে পেয়েছে। এ সবই তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। ফলে তাঁর কাছে কবিতাই ছিল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান এবং কবি পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড় আর এই কবিতার জন্যই সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। তিনি তা স্বীকারও করেছেন তাঁর এই কবিতায়:
শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘের গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।
(শুধু কবিতার জন্য)
শুধু কবিতার জন্য যাঁর ত্যাগ, শিল্পোন্মাদনা, বেঁচে থাকা, অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করা সেই কবির হঠাৎ বিদায় আমাদের জন্য আমাদের কবিতার জন্য এক চরম দুঃসংবাদ বৈকি। ২৩ অক্টোবর যখন শারদীয় দুর্গোৎসবের নবমীর সুরে আনন্দের ফোয়ারা বইছিল কলকাতা জুড়ে তখনই রাত তিনটায় তাঁর আকস্মিক বিদায় সংবাদে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল শরতের সুনীল আকাশ। তাঁর এই আকস্মিক বিদায় সুনীলেরই রচিত ‘মৃত্যুদন্ড’ কবিতার মতই আমাদের কাছে দুর্বহ বেদনাময়।
একটা চিল ডেকে উঠলো দুপুর বেলা
বেজে উঠলো, বিদায়,
…
সমস্বরে ডেকে বললো, তোমায় চিরকালের
বিদায় দিলাম, চিরকালের বিদায় দিলাম, বিদায়;
চতুর্দিকে প্রতিধ্বনি, বিদায়, বিদায়, বিদায়।
তাঁর এই মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বাংলা কবিতায় সুনীল শাসিত এক রোমান্টিক যুগের অবসান ঘটলো বটে, যেখানে আমরা দেখেছি নীরা (যার মধ্যে নারী ও প্রকৃতি একাকার) নামের এক নারীর প্রতীকে দুরন্ত এক প্রেমের পৃথিবী এবং নিখিলেশদের প্রতি কবির আকুতি ভরা আহ্বানে কলকাতার মধ্যবিত্তের দুঃখকষ্টের পৃথিবীকে। কিন্তু শুধু কি কবিতা দিয়ে এ মহৎপ্রাণের বিচার হবে? নানারকম লেখায় যে সমৃদ্ধ তাঁর সাহিত্য ভাণ্ডার। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ, আত্মজীবনী এমনকি নীলউপাধ্যায়, সনাতন পাঠক ও নীললোহিত ইত্যাদি ছদ্মনামে লিখে যে অনন্য সাহিত্য সম্ভার রেখে গেছেন তিনি, বিশেষ করে ‘সেইসময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ যে উপন্যাস উপহার দিয়ে গেছেন তিনি তার জন্য বাঙালি পাঠকের মনে অনেকদিন বেঁচে থাকবেন তিনি। আমাদের কাছে আরও একটি কারণে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরে অকৃত্রিম বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সর্বদাই বাংলাকে অবিভক্ত মনে করতেন এবং জোর গলায় বলতেন ঢাকা-ই হবে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী। তাঁর এই সাহসী সত্যভাষণকে কি সহজে ভোলা যায়!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন-অধ্যায় আটাত্তরে থেমে যাওয়া হয়তো প্রকৃতি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও কিছুদিন। অসুখকে জয় করে, চিকিৎসকের কথাকে হার মানিয়ে সে-বাঁচার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল বৈকি। এই কবিতায় তিনি তো তাই-ই বলতে চেয়েছেন: ‘আমাকে বেঁচে থাকতে হবে/অসম্ভব হলেও অসুখ যদি না বোঝে, তবু/ভাবতেই ভালো লাগে/সত্যি সত্যি সব ডাক্তারকে হারিয়ে দিয়ে/বেঁচে উঠলাম আমি! এই আমি।’