আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান সীমান্তে একটি মালবাহী ট্রেন সেতুর উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নবগঠিত ‘ইসলামিক আমিরাতে’ ঢুকছে। সীমান্তের বিভিন্ন অংশে উজবেকিস্তানের পতাকার পাশে উড়ছে তালেবানের সাদা-কালো পতাকা।
তালেবানের কাবুল দখলের এক মাস পর হায়রাতান সীমান্তে গিয়ে এমনটাই দেখেছেন বিবিসির এক সাংবাদিক।
কট্টরপন্থি ইসলামী গোষ্ঠীটির শাসনামলে আফগানিস্তানের জনজীবন কেমন চলছে, তা দেখতে সম্প্রতি সেখানে যান তিনি।
এসময় তার সঙ্গে কথা বলা অনেক ব্যবসায়ী বলেছেন, তালেবানের ফের ক্ষমতাগ্রহণে তারা খুশি।
গম বোঝাই হচ্ছে এমন একটি ট্রাকের চালক জানান, আগে যখনই সীমান্তের এই চেকপয়েন্ট পেরোতে হত, তখনই তাকে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ দেওয়া লাগত।
“এখন এমন হয় না। আমি এই রাস্তা ধরে কাবুল চলে যেতে পারি এবং এক পয়সাও দেওয়া লাগবে না,” বলেছেন তিনি।
ঘুষ বন্ধ হওয়ায় এই ট্রাকচালক খুশি হলেও তালেবান আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার একমাস পরও নগদ মুদ্রার ঘাটতি ও নানাবিধ সংকট দেশটির অর্থনীতিকে কাবু করে রেখেছে।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এক নেতা বলেছেন, আফগানিস্তানে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে গেছে, আমদানিকারকরা নতুন পণ্যের বিল পরিশোধ করতে পারছেন না।
হায়রাতান বন্দরের শুষ্ক বিভাগের প্রধান মৌলভি সাইদ বিবিসিকে বলেন, ব্যবসা বাড়াতে তারা শুল্ক হার কমিয়ে দিয়েছেন এবং ধনী ব্যবসায়ীদের দেশে ফিরে আসাকে উৎসাহিত করতে চাইছেন।
“এমনটা হলে জনগণের জন্য চাকরি সৃষ্টি হবে আর ব্যবসায়ীরা পরকালে এর পুরস্কার পাবে,” বলেছেন এই তালেবান সদস্য।
হায়রাতান থেকে গাড়ি চালিয়ে মাজার-ই-শরীফ যেতে একঘণ্টার মতো লাগে। এটি আফগানিস্তানের চতুর্থ বৃহত্তম শহর। সেখানেও দৃশ্যত জনজীবন স্বাভাবিক, তবে অনেকেই চরম অর্থনৈতিক সংকটে দিনাতিপাত করছেন।
ছবি বিবিসি থেকে নেওয়া
এখন ব্লু মস্কে নারী-পুরুষদের ঢোকার জন্য আলাদা সময়সীমা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। নারীরা ঢুকতে পারবেন সকালে, বাকি দিন পুরুষদের।
কেরমানি এবার যখন সেখানে যান, তখনও অনেক নারীকে ব্লু মস্কের আশপাশে দেখেছেন, তবে আগের তুলনায় কম।
“সব ঠিক আছে। হয়তো নতুন সরকারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে লোকজনের আরও কিছু সময় প্রয়োজন,” বললেন ভীতসন্ত্রস্ত এক নারী।
বিবিসির সাংবাদিক তালেবানের প্রভাবশালী নেতা হাজি হেকমতের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেন, “আপনারা হয়তো নিরাপত্তা নিয়ে এসেছেন, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, আপনারা এখানকার সংস্কৃতিকেই মেরে ফেলছেন।”
এর জবাবে তালেবান নেতা জোরের সঙ্গে ‘না’ উচ্চারণ করে বলেন, “পশ্চিমা প্রভাব এখানে ২০ বছর ধরে ছিল। ৪০ বছর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ এক বিদেশির কাছ থেকে আরেক বিদেশির কাছে হাতবদল হয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এখন আবার আমাদের সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনছি।”
ইসলাম যেমনটা তিনি বোঝেন, তাতে নারী-পুরুষের মেলামেশা একেবারেই হারাম।
তালেবান জনগণের সমর্থন উপভোগ করছে- এমনটাও মনে করেন হাজি হেকমত। যদিও খানিকটা দূরেই এক নারীকে বলতে শোনা গেল, “এরা ভালো লোক নয়।”
ইসলাম সম্পর্কে তালেবানের ব্যাখ্যার সঙ্গে আফগানিস্তানের দুর্গম, রক্ষণশীল গ্রামগুলোর সংস্কৃতির বিবাদ তুলনামূলক কম হলেও মাজার-ই-শরীফের মতো বড় বড় শহরগুলোর অনেক বাসিন্দাই গত মাসে কাবুল দখলে নেওয়া কট্টরপন্থি গোষ্ঠীটিকে নিয়ে ব্যাপক সন্দিহান।
ছবি বিবিসি থেকে নেওয়া
বিবিসির ওই সাংবাদিক ব্লু মস্ক ছেড়ে আসার সময় প্রধান সড়কের পাশে এক জায়গায় ব্যাপক সংখ্যক উত্তেজিত মানুষের ভিড় দেখতে পান। জনসাধারণকে দেখানোর জন্য সেখানে গুলিবিদ্ধ চারটি মৃতদেহ শোয়ানো অবস্থায় রাখা ছিল। একটি মৃতদেহের গায়ে লেখা ছিল ‘অপহরণকারী’। সাজা এমনই হবে- অন্য অপরাধীদের সতর্ক করতেই এমনটা করা হয়েছে।
তীব্র রোদ, মৃতদেহের গন্ধ সব ছাপিয়ে সেখানে দেখা গেল ব্যাপক মানুষের ভিড়। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ অন্যদের সরিয়ে আরেকটু ভালোভাবে মৃতদেহগুলো দেখার চেষ্টায় লিপ্ত।
সহিংস অপরাধ দীর্ঘদিন ধরেই আফগানিস্তানের বড় শহরগুলোর জন্য বড় সমস্যা ছিল, তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর এই পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়েছে, তা এমনকী তাদের অতি বড় সমালোচকও স্বীকার করবেন।
মৃতদেহগুলো দেখতে আসা এক ব্যক্তি বললেন, “যদি এরা অপহরণকারী হয়, তা হলে যা হয়েছে ভালো হয়েছে। এটা অন্যদের জন্য শিক্ষা।”
তবে শহরের অনেকে আছেন, যারা এখনও নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন না। এদেরই একজন আইনের শিক্ষার্থী ফারজানা।
“প্রতিবার যখনই আমি ঘর থেকে বের হই, তালেবান সদস্যদের দেখে ভয়ে আৎকে উঠি,” বলেন তিনি।
তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, সেটি বেসরকারি। এরকম সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বন্ধ।
ছবি বিবিসি থেকে নেওয়া
ফারজানার কাছে এ বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তিনি বরং বেশি চিন্তিত- তালেবান হয়তো নারীদের চাকরি করতে দেবে না, এটা নিয়ে।
কট্টরপন্থি ইসলামী গোষ্ঠীট এবার ক্ষমতা নেওয়ার সময় বলেছিল, তারা নারীদের কাজে বাধা দেবে না। শেষ পর্যন্ত তারা এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে কিনা, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
আপাতত, আফগানিস্তানের নারীদেরকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ঘরে থাকতে বলেছে তালেবান। তবে শিক্ষক ও চিকিৎসক-নার্সরা কাজে যেতে পারছেন।
“এই মুহুর্তে আশাহত, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী হতে আমি আমার সর্বোচ্চটাই করে যাবো,” বলেছেন ফারজানা।
শেষবার তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তালেবান নারীদের জন্য যত কঠোর নিয়মকানুন জারি করেছিল, এবার এখন পর্যন্ত তাদেরকে ততটা কঠোর দেখা যায়নি। সেসময় নারীরা পুরুষ কোনো আত্মীয়কে ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে পারতেন না। এই ধরনের আইন ফের আফগানিস্তানে জারি হতে পারে- বড় শহরগুলোর অনেক বাসিন্দার শঙ্কা এমনই।
তালেবান হয়তো আফগানিস্তানে তাদের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, কিন্তু দেশবাসীর হৃদয় ও মন জয় করে নেওয়া থেকে তারা এখনও অনেক দূরে।
স্বীকার করে নিলেন হাজি হেকমতও।
“সামরিক উপায়ে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা কঠিন, কিন্তু আইনের শাসন বাস্তবায়ন ও একে সুরক্ষা দেওয়া আরও কঠিন,” বলেছেন তিনি।