ক্লাস চলাকালে দূরত্ববিধি মানছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরে মাস্ক ছাড়া জটলা করে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। শিক্ষক, কর্মচারীদেরও কখনও কখনও মাস্ক ছাড়া দেখা গেছে।
তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ঢোকানোর নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রই নেই।
বেশকিছু স্কুল-কলেজ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রেখেছে, তবে তা ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমই দেখা গেছে।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আজিমপুর গভার্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রভাতি ও দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং কলেজের অধ্যক্ষ মাস্ক খুলেই নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন।
মাস্ক না পরার বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রভাতি শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকি বললেন, “আমরা এতক্ষণ মাস্ক পরেই ছিলাম। মাত্র খুলেছি।”
আর দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক গৌতম চন্দ্র পাল বললেন, “এটা মনের ভুল।”
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও সবাইকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।
ক্লাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এক বেঞ্চে একজন ও দুইজন করে বসতে দেখা গেছে। তবে দুটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের মাস্ক ছাড়াই ক্লাস নিতে দেখা গেছে।
পরে স্কুলে কিছু শিক্ষার্থীকে মাস্ক ছাড়াই ঘুরতে দেখা যায়, কেউ কেউ জটলা করে আড্ডা দিচ্ছল।
দশম শ্রেণির একজন ছাত্রী বললো, “আসলে অনেকে মাস্ক খুলে ফেলে মাঝে মাঝে। তবে ক্লাসের বাইরেও স্বাস্থ্যবিধি যেন মেনে চলার জন্য বলে দিয়েছেন টিচাররা। স্কুলে ঢোকার সময় আমাদের হাত স্যানিটাইজ করা হয়। হাত ধোয়ারও ব্যবস্থা আছে। তবে সবাই হাত ধুতে চায় না।”
একটি কক্ষ অপরিষ্কার থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনই এ স্কুলের অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
তবে এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সব চলছে দাবি করে কলেজের অধ্যক্ষ (রুটিন দায়িত্ব) গোলাম ফিরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনেই চলছি। যেসব শিক্ষার্থী মাস্ক নিয়ে আসে না, তাদের আমরা মাস্কও দিই। শিক্ষার্থীরা এটা স্বেচ্ছায় মেনে নিচ্ছে, তারা আনন্দ পাচ্ছে।”
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যাপিঠে গিয়ে দেখা যায়, হাত ধোয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও খুব কম শিক্ষার্থীই হাত ধুয়ে ক্লাসে প্রবেশ করছে।
এ স্কুলের একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী বললো, তাদের ক্লাসে এক বেঞ্চে একজন করে বসানো হচ্ছে। একজন যে প্রান্তে বসছে, পেছনের বেঞ্চে বসছে তার অপর প্রান্তে।
“কেউ কেউ মাস্ক খুলে আবার পরে। একসাথে আড্ডা দেয়। আবার টিচার আসলে আলাদাভাবে বসে, মাস্ক পরে থাকে।”
প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারীকে মাস্ক ছাড়াই দেখা যায়। অধ্যক্ষ খালেকুজ্জামান জুয়েলের রুমে গিয়ে দেখা যায়, তিনিও মাস্ক খুলে রেখে কথা বলছেন।
স্কুলের স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুরুতেই বলেন, “আমি আগে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে মাস্কটা পরে নিই, তারপর বলি।
“আমরা শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছি, তা বলব না। তবে মানার চেষ্টা করছি। গেইটে মাস্ক দেওয়া আছে, কেউ মাস্ক ছাড়া এলে তাকে মাস্ক দিয়ে দেওয়া হয়। মাস্ক ছাড়া কেউ ঢুকছে না।”
এই স্কুলের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রথম সপ্তাহে উপস্থিত ছিল বলে জানান খালেকুজ্জামান জুয়েল।
শিক্ষার্থী না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি আরও ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফিরবে। তবে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফিরবে না বলেই আমি মনে করছি। কেউ গ্রামে চলে গেছে, কেউ কেউ অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কারও বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে।”
মিরপুর ১২ নম্বরের ডি ব্লকের ঢাকা হলি ফ্লাওয়ার স্কুলে দেখা যায়, মাস্ক ছাড়াই শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা আসা-যাওয়া করছেন। প্রবেশপথে নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কোনো তদারকিও দেখা যায়নি।
অনেক স্কুলে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে তাকেও মাস্ক ছাড়া অন্যদের সাথে কথা বলতে দেখা যায়। তার কক্ষেই একজন শিক্ষার্থী ছিল, যার মুখে মাস্ক ছিল না।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি যে যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না, তা স্বীকার করলেন প্রধান শিক্ষক মান্নান শিকদার।
তিনি বলেন, “বাচ্চাদের আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলি, কিন্তু ছোটরা অনেক সময় মানতে চায় না।”
এই শিক্ষক জানান, তাদের শিক্ষার্থীদের তিন চতুর্থাংশই প্রথম সপ্তাহে ক্লাসে আসছে না। শিক্ষার্থী কমে আসায় তাদের মাস্ক পরতে ‘চাপ দেওয়া যাচ্ছে না’।
“ওদের ততটা জোর করি না। বেশি জোর করলে হয়ত স্কুলেই আসবে না। এমনিতেই আমাদের চার ভাগের একভাগ শিক্ষার্থী আমরা পেয়েছি।”
প্রধান শিক্ষক বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীদের বেতন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা ছিল। আমরা বলে দিয়েছি ৫০০ টাকা নিব। তারপরও স্টুডেন্ট আসেনি। অনেক বাচ্চা গ্রামে চলে গেছে। ওদের বাবা এসে কথা বলে যায়। কিন্তু বাচ্চাদের পাঠাচ্ছে না।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেমি থাকায় অনেক শিক্ষার্থী উদ্বেগেও আছে।
রূপনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বললো, সে স্প্রে করে, হাত ধুয়ে ক্লাসে ঢুকলেও তার সহপাঠীরা উদাসীনতা দেখাচ্ছে।
“সবাই মোটামুটি মাস্ক পরি। কিন্তু টিচার ক্লাসে না থাকলে অনেকে একসাথে হয়ে মাস্ক খুলে কথাবার্তা বলে। স্কুলের বাইরে বের হয়েও অনেকে মাস্ক খুলে ঘুরে বেড়ায়।”
একই কথা বললো ২১ নম্বর পল্লবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্র।
“ক্লাসে কেউ কেউ মাস্ক খুলে রেখে দেয়। স্যারদের সামনে পরে। পরে আবার খুলে ফেলে। এ কারণে আসতে ইচ্ছে করে না, কিছুটা ভয় তো করে। কিন্তু বাসা থেকে বলে আসতে।”
করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্কুলে ভালো লাগছে না জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বললো, “আগের মতো এখন আর ক্লাসে ভালো লাগে না। বন্ধুদের সাথে খেলা যায় না। অনেকে আসছেও না। এখন সবকিছু চেইঞ্জ হয়ে গেছে।”